Advertisement

সাপ কীভাবে কোনো বস্তু দেখতে পায়? (How can snakes see an object?)

 কোনো বস্তু থেকে আলোকরশ্মি যখন প্রতিফলিত হয়ে আমাদের চোখের কর্নিয়ায় আসে, তখন আলোকরশ্মির প্রতিসরণ ঘটে। এই প্রতিসরিত আলোকরশ্মি চোখের অগ্র প্রকোষ্ঠের তরল মাধ্যম অ্যাকুয়াস হিউমার ও পিউপিল হয়ে লেন্সে পৌছাঁয় ( মানুষের চোখের লেন্স স্বচ্ছ, নমনীয় ও দ্বি-উত্তল)। লেন্সে আলোকরশ্মির পুনরায় প্রতিসরণ ঘঠে এবং এই প্রতিসরিত রশ্মি ভিট্রিয়াস হিউমার (ভিট্রিয়াস প্রকোষ্ঠের জেলির মতো স্বচ্ছ পদার্থ) দিয়ে রেটিনায় আসে, তখন রেটিনায় থাকা বিশেষ সংবেদনশীল দুই প্রকার কোষের (কোন কোষ ও রড কোষ) সাহায্য বস্তুর একটি উল্টো প্রতিবিম্ব তৈরী হয়। সর্বশেষে, এই প্রতিবিম্ব সংবেদী অপটিক স্নায়ূর মাধ্যমে মস্তিষ্কের দৃষ্টিকেন্দ্রে পৌঁছালে আমরা বস্তুটিকে দেখতে পাই।


ছবি : চোখে দৃশ্য দেখার প্রক্রিয়া (PC : Rivertown Eye Care)

সাপের দেখার প্রক্রিয়াটা আমাদের থেকে ভিন্ন। সাপের চোখে আমাদের মতো কোনো পাতা (Eyelids) থাকেনা, তার পরিবর্তে এক প্রকারের স্বচ্ছ আঁইশ বা স্কেল থাকে (Spectacle Scales)। এই স্কেলগুলো তাদের চোখকে ধুলাবালি ও অন্যান্য ক্ষতিকর উপাদান থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে। যখন সাপ মল্টিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেহের খোলস বদলায়, তখন চোখের এই স্কেলও পরিবর্তন করে।

সাপের চোখের রেটিনাতে আমাদের মতো কোণ কোষ (Cone cell - এইসব কোষ উজ্জ্বল আলোতে দেখতে সাহায্য করে ও রঙিন বস্তু শনাক্ত করে) ও রড কোষ (Rod cell - এইসব কোষ হালকা বা ঝাপসা আলোতে দেখতে সাহায্য করে) থাকে। আমাদের চোখে তিন ধরনের কোণ কোষ থাকে যেগুলো লাল, সবুজ ও নীল আলোকে শোষণ করতে পারে ( তিন ধরনের রং শনাক্ত করতে পারে এজন্য আমাদের চোখকে Trichromatic দৃষ্টি বলা হয়) । অন্যদিকে সাপের চোখে কেবল সবুজ ও নীল রঙের কোন কোষ থাকে (দুই ধরনের আলো শনাক্ত করতে পারে এজন্য Dichromatic দৃষ্টি), লাল বর্ণ শনাক্ত করার জন্য কোনো কোণ কোষ থাকেনা। তাই সাপ আমাদের মতো দৃশ্যমাণ এই রঙিন বস্তুজগতকে এতোটা রঙিন দেখতে পায়না।

দিবাচর (Diurnal) সাপের চোখে কোণ কোষের পরিমাণ বেশি থাকে, এজন্য এরা দিনের বেলায় ভালো দেখতে পায়। তাছাড়া দিবাচর অনেক সাপের সূক্ষ্ম দৃষ্টির (যেমন : শ্রীলঙ্কান লাউডগা সাপ, কালনাগিনী প্রভৃতি) জন্য তাদের চোখের লেন্স অতিবেগুনী রশ্মিকে ব্লক করে দেয় ও স্পষ্ট দৃশ্যের সূচনা করে । অন্যদিকে, নিশাচর (Nocturnal) সাপের চোখে রড কোষের পরিমাণ অধিক থাকায় তারা হালকা আলোতে (Dim light) ভালো দেখে এবং অতিবেগুনী রশ্মিকে (Ultraviolet ray) ব্লক করতে না পারায় মৃদু-আলোতে ভালোই দেখতে পায়।

সাপের চোখের কোণ কোষে অনেক প্রকারের পিগমেন্ট থাকে যা তাদেরকে বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোকরশ্মি শনাক্ত করতে সাহায্য করে। তবে, বেশিরভাগ সাপই অতিবেগুনী রশ্মিতে প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করে।  

অনেক সাপের দ্বি-নেত্র দৃষ্টি বা বাইনোকিউলার ভিশন থাকে, অর্থাৎ তারা দুই চোখ দিয়ে একই দৃশ্য দেখতে পারে, যেমন : আফ্রিকার বোমস্লাং। বাইনোকিউলার ভিশনের জন্য তারা দুটি চোখ একই দিকে মুখ করে আশেপাশের একটা ত্রিমাত্রিক দৃশ্য ও যেকোনো বস্তুুর দূরত্ব ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারে। আবার অনেক সাপের চোখ মনোকিউলার ভিশন ধরনের, অর্থাৎ চোখ মাথার দুইপাশে দুইটা হওয়ায় কোনো বস্তুকে দুইচোখ দিয়ে একইসাথে দেখতে পারেনা। ফলে, কোনো বস্তুর দূরত্ব ও গভীরতা সঠিকভাবে অনুমান করতে পারেনা।

সাপ কিন্তু কোনো স্থির বস্তুকে ভালোভাবে দেখতে পারেনা, তার পরিবর্তে এরা গতিশীল (Dynamic) বস্তুগুলো ভালোভাবে দেখে। 

অনেক প্রজাতির সাপে, বিশেষকরে পিট ভাইপার, পাইথন, বোয়া প্রভৃতিতে একটি বিশেষ সংবেদনশীল অঙ্গ থাকে যাকে পিট (Pit) বলা হয়। এই পিট দিয়ে এরা পুরোপুরি অন্ধকার জায়গায়ও ভালোভাবে দেখতে পারে। সাপের পিট অর্গান মূলত একটা হিট সেন্সর। আরো ভালোভাবে বললে তৃতীয় চোখ। পিট অঙ্গ সমৃদ্ধ সাপের যদি চোখ নাও থাকে, তবুও তারা তাদের শিকার ধরে খেয়েদেয়ে বেঁচে থাকতে পারবে।


ছবি : সাপের পিট অর্গান (PC : A-Z Animals) 

আমরা জানি আমাদের আশেপাশের সব উত্তপ্ত বস্তু প্রতিনিয়ত পরিবেশে তাপ বিকিরণ করতে থাকে।প্রানিদের দেহও পরিবেশে প্রতিনিয়ত তাপ বিকিরণ করে। বিকিরিত এই তাপ বিভিন্ন তাড়িতচৌম্বকীয় তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের আলো হিসেবে পরিবেশে মুক্ত হয়। আমরা জানি আমরা কেবল ৩৮০ ন্যানোমিটার থেকে ৭৮০ ন্যানোমিটার তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের মধ্যে যেসব আলো থাকে তাদেরকে দেখতে পাই। ৩৮০ ন্যানোমিটারের চেয়ে কম কিংবা ৭৮০ ন্যানোমিটারের চাইতে বেশি কোনো আলো আমাদের কাছে দৃশ্যমান হবেনা। ৩৮০ ন্যনোমিটারের তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের কম তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের আলোকে অতিবেগুনী রশ্মি (Ultraviolet ray) এবং ৭৮০ ন্যানোমিটারের বেশি তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের আলোকে অবলোহিত রশ্মি (Infrared ray) বলা হয়।


ছবি : দৃশ্যমান আলোক বর্ণালী ( PC : Freepik), আলোক বর্ণালীর খুবই ছোট্ট একটা অংশকে আমরা দেখতে পাই, বেশিরভাগই আমাদের কাছে অদৃশ্য 

কিন্তু সাপ তাদের পিট অর্গানের মাধ্যমে আমাদের কাছে অদৃশ্য অবলোহিত আলোকরশ্মিকে শনাক্ত করতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, সাপ ৫০০০ থেকে ৩০০০০ ন্যানোমিটার পর্যন্ত তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের অবলোহিত আলোকরশ্মিকেও শনাক্ত করতে পারে। 

পিট ভাইপারদের এই পিট অঙ্গটি খুবই শক্তিশালী হয়ে থাকে, এজন্য এরা অন্ধকারেও খুব ভালোভাবে দেখতে পারে।

Post a Comment

0 Comments