নিউরোটক্সিন : নিউরোটক্সিন হচ্ছে এক প্রকারের বিষ যা মানবদেহের স্নায়ূ কলাকে আক্রমণ করে। কিছু রাসায়নিক পদার্থ যেমন : সীসা, নাইট্রিক অক্সাইড, ইথানল প্রভৃতি নিউরোটক্সিন হতে পারে।
মানবদেহের স্নায়ূতন্ত্রের স্নায়ূ টিস্যুগুলো বিশেষ এক প্রকারের কোষ দিয়ে গঠিত যাদেরকে নিউরন বলা হয়। একটি আদর্শ নিউরন কোষে তিনটি অংশ থাকে, যথা : কোষদেহ, ডেনড্রন ও অ্যাক্সন। মানবদেহের বিভিন্ন কার্য সম্পাদনের জন্য একটি নিউরনের সাথে অন্য একটি নিউরনের যোগাযোগ থাকতে হয়।
![]() |
ছবি : নিউরন সেল (PC : freepik) |
কিন্তু একটি নিউরনের সাথে অন্য একটি নিউরনের সরাসরি কোনো সংযোগ থাকেনা, এর পরিবর্তে দুটি নিউরনের সংযোগস্থলে একটি ফাঁকা স্থান থাকে যাকে সিন্যাপস (Synapse) বলা হয়। যখন কোনো নিউরন থেকে অন্য নিউরন বা দেহের কোনো পেশি বা গ্রন্থিতে কোনো তথ্য পরিবহনের প্রয়োজন পড়ে, তখন সেখানে এক প্রকারের রাসায়নিক বস্তু দূত বা বার্তাবাহক হিসেবে কাজ করে যাদেরকে নিউরোট্রান্সমিটার (Neurotransmitters) বলা হয়। এই নিউরোট্রান্সমিটার হিসেবে অনেক প্রকারের রাসায়নিক বস্তু ব্যবহৃত হতে পারে। উল্লেখযোগ্য কিছু নিউরোট্রান্সমিটার হলো - অ্যাসিটাইল কোলিন, ডোপামিন, গ্লুটামেট, অ্যাড্রেনালিন প্রভৃতি। এদের মধ্যে অ্যাসিটাইল কোলিন সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
![]() |
ছবি : সিন্যাপসে নিউরোট্রান্সমিশন প্রক্রিয়া (PC : Cleveland Clinic) |
বিভিন্ন প্রকারের নিউরোটক্সিন বিভিন্নভাবে এই স্নায়ূতন্ত্রকে আক্রমণ করে থাকে।
ডেনড্রোটক্সিন : এই বিষ নিউরোট্রান্সমিশন প্রক্রিয়াকে বন্ধ করে দিয়ে দেহের নার্ভ ইমপালসকে (Nerve impulse : তড়িৎ রাসায়নিক সিগনাল যা একটি নিউরন থেকে অন্য নিউরনে প্রবাহিত হয়ে দেহের বিভিন্ন কার্য সম্পাদন করে থাকে) বন্ধ করে দেয়, যার ফলে মানুষের অনুভূতি ক্ষমতা (তাপমাত্রা অনুভব করা, স্পর্শ, কোনো কিছুর স্বাদ নেয়া, গন্ধ নেয়া ইত্যাদি) বিকল হয়ে যায়। এই ডেনড্রোটক্সিন আমাদের নার্ভকে প্যারালাইজডও করে দিতে পারে, ফলে ঘাড়, পিঠ ও মাথায় তীব্র ব্যাথা, মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত কিংবা স্ট্রোকও হতে পারে।
আফ্রিকা মহাদেশের Dendroapsis গণের যে চারটি মাম্বা আছে তাদের বিষে ডেনড্রোটক্সিন পাওয়া যায়।
আলফা-নিউরোটক্সিন : এগুলো নিকোটিনিক অ্যাসিটাইল কোলিন নামক রিসেপ্টরগুলোকে আক্রমণ করে, যেগুলো অ্যাসিটাইল কোলিন নিউরোট্রান্সমিটারের প্রতি সাড়া প্রদান করে থাকে। এই আলফা-নিউরোটক্সিন বিষের বিষাক্ত কেমিক্যালগুলো অ্যাসিটাইল কোলিনের আকৃতি নকল করে তার জায়গা দখল করে মানুষের স্নায়ূতন্ত্রের স্বাভাবিক কাজকর্মে ব্যঘাত সৃষ্টি করে, যার ফলে দেহ প্যারালাইসিস হয়ে যাওয়া, বিকল ও অসার হয়ে যাওয়া ইত্যাদি লক্ষণ প্রকাশ পায়।
এলাপিডি পরিবারের Hydrophiinae উপপরিবারভূক্ত সামুদ্রিক সাপগুলোর বিষে শক্তিশালী নিউরোটক্সিন থাকে। শঙ্খচূড় (King Cobra) এর দেহেও শক্তিশালী নিউরোটক্সিন বিষ থাকে। মায়ানমার, ভিয়েতনাম, লাওস প্রভৃতি দেশে প্রাপ্ত Many banded Krait সাপে আলফা-বোঙ্গারোক্সিন, নাজা গণের ইন্দোচাইনিজ স্পিটিং কোবরা (Naja siamensis), চাইনিজ কোবরা (Naja atra) প্রভৃতি সাপের বিষে আলফা-কোবরাটক্সিন নামক শক্তিশালী নিউরোটক্সিন বিষ থাকে।
নিউরোটক্সিন বিষক্রিয়ার লক্ষণ -
- চোখে সবকিছু ঝাপসা ঝাপসা দেখা (Double vision / Blurred Vision), চোখের পাতা পড়ে আসা (Ptosis)
- ঘুম ঘুম ভাব বা তন্দ্রাচ্ছন্নতা (Drowsiness)
- দেহে প্যারাইলাইসিস ঘঠা (Paralysis)
- কথা বলতে কষ্ট হওয়া, উল্টাপাল্টা কথাবার্তা বলা, স্পষ্টভাবে বোঝা যায় না এমন কথাবার্তা বলা (Slurred Speech / Dysarthria)
- অজ্ঞান হয়ে যাওয়া (Unconsciousness)
- কামড়ের আশেপাশের জায়গার কোষগুলোর মৃত্যু ঘঠা (যাকে Necrosis বলা হয়) ইত্যাদি।
![]() |
ছবি : ডিপ্লোপিয়া বা ডাবল ভিশন (PC : Optometrists Clinic Inc) |
বাংলাদেশের নিউরোটক্সিন বিষধর সাপ
বাংলাদেশের প্রায় সবকটি সামুদ্রিক সাপ (রঙিলা সামুদ্রিক সাপ, পাতাল নাগিনী, বঁড়শিনাক সামুদ্রিক সাপ, বৈঠাটেবি সামুদ্রিক সাপ, লাঠি সামুদ্রিক সাপ প্রভৃতি) উচ্চতর শক্তিশালী নিউরোটক্সিন বিষ ধারণ করে। স্থলে বসবাসকারী সাপ, যেমন : শঙ্খিনী, শঙ্খচূড়, পদ্ম গোখরা, খৈয়া গোখরা, পাতি কালাচ, ছোট কৃষ্ণকালাচ, বড় কৃষ্ণকালাচ, ওয়ালের কালাচ, গৌরের প্রবাল সাপ, ম্যাক্লেল্যান্ডের প্রবাল সাপ ইত্যাদি নিউরোটক্সিন বিষধর। বাংলাদেশের অনেক মৃদু-বিষধর সাপও দূর্বল নিউরোটক্সিন বিষধর।



0 Comments