মানবদেহের রক্তে প্রধানত তিন ধরনের রক্তকোষ পাওয়া যায়, লোহিত রক্তকণিকা (Erythrocyte) যেগুলো প্রধানত দেহে অক্সিজেন ও কার্বনডাইঅক্সাইড পরিবহন করে। শ্বেত রক্তকণিকা (Leukocyte) যেগুলো দেহেকে যাবতীয় রোগজীবাণুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করে এবং অণুচক্রিকা (Thrombocyte) যেগুলো দেহের রক্তপাত বন্ধ করে।
![]() |
ছবি : মানবদেহের তিন ধরনের রক্তকোষ (PC : Freepik) |
মানবদেহের কোনো রক্তনালী যখন কেটে যায়, তখন সেখানে অবিরত ধারায় রক্তপাত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু আমাদের দেহের অণুচক্রিকা হেমোস্ট্যাটিস প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই মারাত্মক রক্তপাত থেকে দেহকে রক্ষা করে থাকে। এখানে কোয়াগুলেইশান নামক একটি প্রক্রিয়া জড়িত থাকে ( Coagulation : যে প্রক্রিয়ায় রক্ত তরল থেকে জেলিতে রূপান্তরিত হয়ে থ্রম্বাস -Thrombus গঠন করে দেহ থেকে অতিরিক্ত রক্ত বের হতে দেয়না)।
দেহের এই রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়াটি খুবই জটিল, যেখানে অণুচক্রিকাকে আরো প্রায় ১৩ ধরনের বিভিন্ন ফ্যাক্টর সাহায্য করে থাকে। এখানে জড়িত থাকে ফাইব্রিনোজেন নামক বিশেষ এক প্রকারের প্রোটিন।
![]() |
ছবি : ব্লাড কোয়াগুলেশন প্রক্রিয়া (PC : Brittanica) |
হেমোটক্সিন বিষ এই কোয়াগুলেইশান প্রক্রিয়াতে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে, অণুচক্রিকাকে একত্রিত হয়ে জমাট বাঁধতে বাঁধা দেয়, ফাইব্রিনোজেন প্রোটিনকে ভেঙে দেয় কিংবা রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়াকে একেবারেই বন্ধ করে দিতে পারে। যার ফলে সাপে কামড়ানো স্থানের পাশাপাশি দেহের অভ্যন্তরে মারাত্মক রক্তপাত হয়।
মানবদেহে হেমোটক্সিন বিষক্রিয়ায় আরেকটি ভয়াবহ ঘঠনা ঘঠতে দেখা যায় যাকে Hemorrhage বলা হয়। এই প্রক্রিয়ায় দেহের রক্তনালী থেকে ভয়াবহ মাত্রায় রক্ত বের হতে পারে। পাশাপাশি দেহের পুরো রক্ত সংবহনতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্থ করা কিংবা দেহের মাংসপেশিকে ধ্বংস করাও উল্লেখযোগ্য বিষক্রিয়া হতে পারে।
বাংলাদেশের চন্দ্রবোড়া (Russell’s Viper, Daboia russelii), গেছোবোড়া (Red-tailed Baboo Pitviper, Trimeresurus erythrurus) ও পপের সবুজবোড়া (Pope's Bamboo Pit-viper (Trimeresurus popeiorum) সাপে এই ধরনের হেমোটক্সিন বিষ থাকে। তবে রাসেল'স ভাইপারে হেমোটক্সিনের মতো এই দুটি পিটাভাইপারের বিষ এতোটা তীব্র নয়, মৃত্যুর পরিবর্তে অঙ্গহানী ঘঠার সম্ভাবনাই প্রবল।
ভারতের অন্যতম ভয়ানক সাপ Indian Saw-scaled Viper (Echis carinatus) যেটি প্রতিবছর প্রচুর মানুষকে মেরে ফেলে, সেটাও হেমোটক্সিন বিষধর।
বিভিন্ন প্রকারের রাসায়নিক পদার্থ দেহে হেমোটক্সিসিটি সৃষ্টি করতে পারে। তারমধ্য উল্লেখযোগ্য কিছু পদার্থ হলো -
Snake Venom Metalloproteinases (SVMPs) : এগুলো বিভিন্ন প্রকারের প্রোটিন যা মানবদেহের ফাইব্রিনোজেনেকে ভেঙে দেয়, অণুচক্রিকার জমাট বাঁধা প্রতিহত করে কিংবা দেহে Hemorrhage অবস্থা সৃষ্টি করতে পারে। প্রধানত ভাইপারিডি পরিবারের সাপদের দেহে পাওয়া যায়, তবে হালকা ঘনমাত্রায় এলাপিডি, অ্যাট্রাক্টাসপিডিডি ও কলুব্রীডি পরিবারের সাপেও পাওয়া যেতে পারে। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, সাপের দেহে SVMP এর উপস্থিতি তার পরিবেশের উপর অনেকটাই নির্ভরশীল।
SVMP বহনকারী কিছু সাপ -
জাপানের হাবু সাপ ( Protobothrops flavoviridis), দক্ষিণ আমেরিকার আটলান্টিক বুশমাস্টার (Lachesis muta), আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল ও প্যারাগুয়ের জারারাকা (Bothrops jararaca) ও আমাদের রাসেল'স ভাইপার (Daboia russelli)
Snake Venom Serine Protease (SVSP) : এগুলোও মূলত প্রোটিন যা বিভিন্ন প্রকারেরর এনজাইম হিসেবে কাজ করে। দেহের রক্তচাপ হুট করে কমিয়ে ফেলা, রক্তজমাট বাঁধতে বাঁধা দেয়া ও ফাইব্রিনোজেনকে ভেঙে ফেলার জন্য দায়ী।
SVSP বহনকারী কিছু সাপ
দক্ষিণ আমেরিকার Whitetail Lancehead (Bothrops leucurus) ও Jararacussu (Bothrops jararacussu), আফ্রিকার পাফ এডার (Bitis arietans) ও ইউরোপ-এশিয়ার Nose-horned Viper (Vipera ammodytes)
হেমোটক্সিন বিষক্রিয়ার লক্ষণ (Symptoms of Hemotoxicity)
- কামড়ের স্থান থেকে স্বতস্ফূর্তভাবে প্রচুর রক্তপাত হওয়া
- কামড়ের স্থান ছাড়াও ভয়ানকভাবে অভ্যন্তরীণ রক্তপাতও ঘঠতে পারে (Severe Internal Bleeding)
- বমি বমি ভাব করা (Nausea) বা বমি হওয়া (Vomiting)
- তীব্র মাথাব্যথা, বুকে ব্যথা বা তলপেটে ব্যথা
- অস্বাভাবিক হার্টবিট ( হার্ট অনেক দ্রুত কিংবা খুবই ধীরে ধীরে বিট করা যাকে Arrhythmia বলা হয়)
- দেহের রক্তচাপ বা ব্লাড প্রেসার কমে যাওয়া (Hypotension)
- শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া
- মানসিক ভারসাম্যহীনতা, শরীর খুবই দূর্বল হয়ে যাওয়া
- এছাড়াও জ্বর, অজ্ঞান হওয়া কিংবা মাথাঘোরানোর মতো লক্ষণও দেখা দিতে পারে।


0 Comments