Advertisement

পদ্ম গোখরা (Monocled Cobra)

পদ্ম গোখরা (অনেকে কেউটে বলে থাকেন) হলো এলাপিডি পরিবারভূক্ত একটি শক্তিশালী নিউরোটক্সিন বিষধর সাপ। এই সাপের ইংরেজি নাম : Monocled Cobra এবং বৈজ্ঞানিক নাম Naja kaouthia।  এদের ফণার পিছনে প্রায় বৃত্তাকার একটি চোখের আকৃতির মতো / আংটির মতো বা ইংরেজী O আকৃতির দাগ বা চিহ্ন থাকে যা দ্বারা এদেরকে " খৈয়া গোখরা ( Spectacled Cobra) " থেকে পৃথক করা যায়। ইংরেজি Monocled শব্দের অর্থ হল একচোখা চশমা। কেউটে শব্দটি সংস্কৃত " কালকূট " থেকে এসেছে।


ছবি : পদ্ম গোখরা (Collected from Khao Sok National Park) 

পদ্ম গোখরা মূলত নিশাচর (Nocturnal) স্বভাবের সাপ, তবে দিনের বেলায়ও সক্রিয় থাকতে পারে। স্বভাবে এরা খুবই রাগী ও ক্ষ্যাপাটে, এমনকি খৈয়া গোখরার চাইতেও বেশি রাগী। মানুষের বসতবাড়ির আশেপাশে থাকে, তবে জলাজায়গায় থাকতে বেশি পছন্দ করে। এছাড়াও আবাদি জমি, বনাঞ্চল বা ধানক্ষেতের ইদুরের গর্তে থাকতে পারে। এদের খাদ্য তালিকায় রয়েছে ইদুর, ব্যাঙ, ছোট মাছ, ছোট সাপ, শামুক প্রভৃতি।

জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত এদের প্রজননকাল। এসময় মা সাপ ইঁদুরের গর্ত, গাছের ভেতরের ফাঁকা জায়গা, পাথরের চিপা, মাটির গর্ত প্রভৃতি স্থানে ১৬-৩৩ টি ডিম পাড়ে। ৫৫ থেকে ৭৩ দিন পড়ে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয় এবং এর আগ পর্যন্ত এরা ডিমের গুচ্ছকে (Clutch) সারা শরীর দিয়ে প্যাঁচিয়ে পাহারা দেয়, ফলে এসময় এরা খুবই আক্রমণাত্মক হতে পারে।

বাংলাদেশের সর্বত্রই পদ্ম গোখরাকে পাওয়া যায়। সিলেট ও চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চল থেকে শুরু করে ঢাকা শহর, উত্তররাঞ্চল থেকে দক্ষিণের সুন্দরবন পর্যন্ত এদের বিস্তৃতি। তবে, অঞ্চলভেদে এদের বিষের তীব্রতার বেশ তারতম্য হয়ে থাকে। বাংলাদেশ ছাড়াও পদ্ম গোখরাকে ভারত, চীন, ভিয়েতনাম,  ভূটান, কম্বোডিয়া, নেপাল, মিয়ানমার, লাওস প্রভৃতি দেশে পাওয়া যায় ।

পদ্ম গোখরার শরীরের রং কালো বা ধূসর হতে পারে, পাশাপাশি কখনও কখনও শরীরের বিভিন্ন ধরনের রঙের প্যাটার্নও (সাধারণত সাদা/ হলদু প্রভৃতি রঙের)  লক্ষ্য করা যায়। তবে বিরল ক্ষেত্রে পুরো সাদা (সাধারণত অ্যালবিনো হলে) সাপও দেখা যায় । আসলে পদ্ম গোখরার গায়ের রঙ ও প্যাটার্ন বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রকমের হতে পারে, অনেকক্ষেত্রে গায়ের রঙের পার্থক্যের জন্য ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতি মনে হতে পারে। এদের গায়ের আইশ কিছুটা ফোলা ফোলা মনে হয়, আইশের মাঝখানে কখনো কোনো ধরনের রঙ থাকেনা (খৈয়া গোখরায় আইশের মাঝখানে সাদা সাদা দাগ দেখা যায়) এবং আইশের আকৃতি অনেকটা মুরগির ডিমের মতো।

পদ্ম গোখরা খৈয়া গোখরার মতো দীর্ঘক্ষণ ফণা তুলে থাকতে পারে না। এদের ফণা বেশ পুরো কিন্তু কম প্রসারিত ও লম্বাটে গড়নের (এটিই মূলত এদেরকে খৈয়া গোখরা থেকে আলাদা করার সবচেয়ে কার্যকরী পদ্ধতি)। 

পদ্ম গোখরা প্রায় ১.৩৫ থেকে ১.৫ মিটার (৪.৪ থেকে ৪.৯ ফুট) লম্বা হতে পারে। এরা মারাত্মক নিউরোটক্সিন বিষ সমৃদ্ধ। এদের কামড়ানোর ৪-৬ ঘন্টার মধ্যে বিষক্রিয়া শুরু হয়। এদের বিষ নিউরোটক্সিন হওয়ায় মানবদেহের স্নায়ূতন্ত্রকে আক্রমণ করে, ফলে প্যারালাইসিস হতে পারে। এছাড়াও এরা কার্ডিওক্সিন ( হৃদযন্ত্রকে আক্রমণ করে) ও মায়োটক্সিন (মাংসপেশিকে আক্রমণ করে) বিষও ধারণ করে। মনোকল্ড কোবরার বিষের SCLD50 এর মান দেশভেদে ভিন্ন হয়। যেমন : থাইল্যান্ডে 0.18-0.22 মিলিগ্রাম /কেজি, মালয়েশিয়ায় 0.90-1.11 মিলিগ্রাম /কেজি এবং ভিয়েতনামে 0.90-1.00 মিলিগ্রাম /কেজি। বিষের তীব্রতা বেশি হওয়ায় বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা পড়ে এই পদ্ম গোখরা আর খৈয়া গোখরার কামড়ে।

কামড়ের স্থানে জ্বালা-যন্ত্রণা হতে থাকে এবং আক্রান্ত স্থান থেকে রক্তের প্লাজমা বের হতে থাকে, সময়ের সাথে সাথে যন্ত্রণা বাড়তে থাকে এবং শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। বমি বা বমি বমি ভাব হয়। মুখ থেকে লালাঝড়ে। গলায় ব্যাথা হয়, ঢোক গিলতে কষ্ট হয়।শ্বাসকষ্ট শুরু হয়,স্মৃতিশক্তি লুপ পেতে থাকে। চোখের পাতা পড়ে আসে এবং রোগী এক পর্যায়ে অজ্ঞান হয়ে যায় এবং মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

পদ্ম গোখরাকে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়। যেমন - আলকেউটে, কালকেউটে, পদ্ম গোখরা, গোক্ষুর গোখরা, কেউটে, গেড়িভাঙা, কালো খরিশ,পদ্ম খরিস, শামুকভাঙা, তপ, মাছূয়ালত/মাছূয়া আলদ /আটালি (সিলেট), ফুল জোরো (চট্টগ্রাম), কালি জাইত সাপ (বরিশাল), কালি ফানো বা কালী হান্নক (কুমিল্লা), গোমা (রাজশাহী), গুমা (জামালপুর), কাল গুক্কু (পাবনা), হানক (নোয়াখালী), ম্যাছা আলা (বগুড়া), গোমা সাপ (নীলফামারী), কালি ফানো (চাঁদপুর), মাছী আলদ (নাটোর), মাছূয়া আলাদ (কুড়িগ্রাম), কালি পানস (নারায়ণগঞ্জ), কালী ফানস সাপ (নরসিংদী) ইত্যাদি।

Post a Comment

0 Comments