' চন্দ্রবোড়া ' হচ্ছে ভাইপারিডি পরিবারভূক্ত খুবই উগ্র স্বভাবের তীব্র বিষধর একটি সাপ। এর ইংরেজি নাম Russell’s Viper এবং বৈজ্ঞানিক নাম Daboia russelii। একে উলুবোড়ো নামেও ডাকা হয়। অনেকে বিদ্রুপাত্মকভাবে কিলিং মেশিনও ডাকেন। অন্যান্য নামের মাঝে আছে Chain Viper, Chain Snake প্রভৃতি । স্কটল্যান্ডের সরীসৃপবিদ স্যার প্যাট্রিক রাসেলের নামানুসারে এর নাম Russell’s Viper করা হয়।
প্রাপ্তবয়স্ক সাপের দেহের দৈর্ঘ্য সাধারণত ১-১.৮ (৪-৫.৫ ফুট) মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। চন্দ্রবোড়ার মাথা ত্রিকোণাকার, চ্যাপ্টা। সারা দেহে কালো গোলাকার (রিংয়ের মতো) দাগ থাকে। দেহ বেশপুরু, শক্তপোক্ত অমসৃন আইশ দ্বারা আবৃত। মাথা ত্রিকোণাকৃতির ছোট আইশে সন্নিবেষ্টত এবং ফণাবিহীন ।
এদের দেহ সাধারণত বাদামী রঙের হয়ে থাকে, তবে দেহে অসংখ্য গোলাকৃতির মার্ক থাকে। এই মার্কগুলোর পরিধি বরাবর পাতলা সাদা রঙের একটি লেয়ার থাকে, তারপর কালো রঙের বড় একটা লেয়ার, এবং সর্বশেষে ভিতরে থাকে বাদামী রঙ। চন্দ্রবোড়ার মাথা ঘাড় থেকে পৃথকযোগ্য, তুন্ড ভোঁতা ও গোলাকৃতির।
রাসেল' ভাইপারের দেহ মোটাসোটা ধরনের হওয়ায় অনেকে একে অজগর (নির্বিষ) কিংবা বোয়া (নির্বিষ) মনে করে ভূল করে থাকেন। তবে, দেহের আকৃতির সাথে মিল থাকলেও নকশা ও ছাপের মাধ্যমে রাসেল'স ভাইপারকে অন্যান্য সাপ থেকে আলাদা করা যায়।
![]() |
ছবি : চন্দ্রবোড়া সাপ (Source : Wikipedia) |
চন্দ্রবোড়া সাপ খুবই অলস এবং শান্তপ্রকৃতির সাপ হিসেবে থাকে কিন্তু যদি এই সাপকে বিরক্ত করা হয়, ভীতি প্রদর্শন করা হয়, তখন শত্রু ভেবে আতংকিত হয়ে পড়ে এবং তখনই কেবল আক্রমনাত্মক হয়ে থাকে,যার ফলস্বরূপ তীব্র বেগে দংশন করে। আসলে এরা মানুষের উপস্থিতি তাদের জন্য হুমকিস্বরূপ মনে করে,এজন্য মানুষকে দেখলেই রাগে হিস হিস শব্দ করে অনেকটা প্রেসার কুকারের মতো এবং খুবই দ্রুতগতিতে আক্রমণ করে
রাসেল'স ভাইপার বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, মায়ানমার, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশে পাওয়া যায়। বাংলাদেশের রাজশাহী অঞ্চলে এ সাপ বেশি পাওয়া যায়। এরা শুষ্ক আবহাওয়া অধিক পছন্দ করে, ভেজা আবহাওয়া ও ঘন ঝোপঝাড় এড়িয়ে চলে। এজন্য হয়তো বৃহত্তর সিলেট ও বৃহত্তর চট্টগ্রামে এদের বিস্তার এখন পর্যন্ত ঘঠেনি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের প্রায় ২৬/২৮টি জেলায় এটি ভয়ানকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে এবং মানুষের দংশনের নিয়মিত খবর মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাড়িয়েছে।
রাসেল'স ভাইপার মূলত নিশাচর (Nocturnal) হলেও দিনে বেশ সক্রিয় থাকে। প্রধানত স্থলে বসবাসকারী হলেও এদেরকে পানিতেও পাওয়া যায় এবং সাঁতার কাটতে দক্ষ। এরা আবাদিজমি, ঝোপঝাড়,খোলা তৃণভূমি,পাথরের চিপা ইত্যাদি জায়গায় থাকে। বিশ্রামের সময় গর্ত, মাটির ফাটলে, পাতার নিচে অবস্থান নেয়। ভয় না পেলে অথবা আতংকিত না হলে এরা খুবই মন্তর গতিতে চলাফেরা করে এবং একই স্থানে দীর্ঘ সময় থাকে।
মুলত ইঁদুরের খোঁজে বসতবাড়িতে আসতে পারে। ইঁদুর এদের পছন্দের খাবার। এছাড়াও ব্যাঙ, ছোট সরীসৃপ,পাখি, গিরগিটি,আথ্রোপোডা পর্বভূক্ত বিভিন্ন প্রাণী ইত্যাদি খায়।।
চন্দ্রবোড়া সাপ ডিম পাড়ার পরিবর্তে সরাসরি বাচ্চা দেয়। এরা বছরের যে কোনো সময় প্রজনন করে এবং প্রজননের সময় ২০- ৪০টি বাচ্চা দেয়। তবে কোনো কোনো চন্দ্রবোড়া সাপের ৭৫টি পর্যন্ত বাচ্চা দেয়ার রেকর্ড আছে।
এরা খুবই উগ্র স্বভাবের (যখন ভয় পায়) এবং তীব্র হেমোটক্সিন বিষ সমৃদ্ধ হওয়ায় প্রতিবছর এদের কামড়ে প্রচুর লোক মারা যায়। এদের বিষ মানবদেহের লোহিত রক্ত কনিকাকে (Red blood cell or Thrombocyte) আক্রমণ করে এবং ভেঙে ফেলে। ফলে এদের কামড়ে শরীর থেকে প্রচুর রক্তপাত হয়। এটির বিষের SCLD50 এর মান 0.75 মিলিগ্রাম /কেজি। বিষের তীব্রতার দিক দিয়ে এরা পৃথিবীর ৩৩তম বিষধর সাপ এবং বাংলাদেশের ৭ম বিষধর সাপ (গ্লোবাল SCLD চার্ট অনুযায়ী)
চন্দ্রবোড়া সাপে কামড়ানোর লক্ষন -
দংশিত স্থান ফুলে যাবে,প্রচূর রক্তক্ষরণ হবে এবং প্রচণ্ড ব্যথা অনুভূত হবে। চোখের পাতা পড়ে আসবে। দাতের মাড়ি,নাক প্রভৃতি স্থান দিয়ে রক্ত পড়তে থাকবে। বমি হবে এবং বমির সাথে রক্ত বের হবে। কফ ও থুতুর সাথেও রক্ত বের হবে। মলত্যাগের সাথে এবং প্রস্রাবের সাথে রক্ত বের হবে। এছাড়াও আরো কিছু উপসর্গ দেখা দিবে এবং আক্রান্ত ব্যাক্তি তীব্র যযন্ত্রনা ভোগ করে মারা যেতে পারে
কাউকে রাসেল'স ভাইপার কামড়ালে এক মূহুর্তও দেরি না করে যতদ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে,সঠিক সময়ে চিকিৎসা পেলে রোগীর বাঁচার সম্ভাবনা থাকে।

0 Comments