Advertisement

সাপের বিষ : সাইটোটক্সিন , কার্ডিওটক্সিন ও মায়োটক্সিন (Venom of Snakes : Cytotoxin, Cardiotoxin and Myotoxin)

 সাইটোটক্সিন 

সাইটোটক্সিন হচ্ছে এমন সব রাসায়নিক পদার্থ (প্রোটিন) বা বিষ যা দেহকোষকে ধ্বংস করে দেয়।

আমরা জানি প্রতিটা প্রাণী " কোষ " নামক অতিক্ষুদ্র একটি গাঠনিক ও কার্যিক একক দ্বারা গঠিত। উন্নত প্রাণীদের কোষের গঠন বেশ জটিল। তবে প্রত্যেকটি কোষের কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য থাকে, কোষঝিল্লি (Plasmalemma) তার মধ্যে অন্যতম। এই কোষঝিল্লি বা কোষপর্দা পুরো কোষকে বেষ্টনী দিয়ে রাখে, কোষের একটি রক্ষণশীল আবরণের মতো কাজ করে এবং অসংখ্য জৈবিক কার্য সম্পাদন করে।

গবেষণায় দেখা গেছে, কোষঝিল্লি লিপিড ও প্রোটিনের জটিল সমন্বয়ে একটি দ্বিস্তরী পর্দারূপে বিরাজ করে। 

সাইটোটক্সিক বিষগুলো কোষপর্দার লিপিডের এই দ্বিস্তরী আবরণের সাথে যুক্ত হয়ে কোষঝিল্লির গঠন ও কাজকে পরিবর্তন করে দিতে পারে কিংবা কোষকে বিদীর্ণ করে দিতে পারে। যারফলে কামড়ের স্থান প্রচুর ব্যথাসহ ফুলে উঠে ও পানি জমে যায়। যন্ত্রণাদায়ক ফোস্কা বা গুটি গুটি বের হয় কিংবা কোষগুলোই মারা যায়।

সাইটোটক্সিন বিষক্রিয়ার লক্ষণগুলো হলো

কামড়ের স্থানে প্রচন্ড ব্যথা করা

মাথাব্যথা, মাথাঘোরানো বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়া

চোখে সবকিছু ঝাপ্সা দেখা

ডায়রিয়া হওয়া

বমি বমি ভাব (Nausea) বা বমি করা (Vomiting) 

চোখ, ত্বক ও মিউকাস পর্দায় যন্ত্রণা করা

আক্রান্ত স্থান হতে রক্ত পড়া

দেহ প্যারালাইজড হয়ে যাওয়া

সব সাপের বিষেই আসলে সাইটোটক্সিন থাকে, তবে বর্ণনার সুবিধার জন্য আমরা নিউরোটক্সিন, হেমোটক্সিন, কার্ডিওটক্সিন, মায়োটক্সিন ইত্যাদি নামে বিভক্ত করে থাকি। আসলে কোন বিষ কোন অঙ্গকে আক্রমণ করছে তার উপর ভিত্তি করেই এইসব বিভাজন করা হয়ে থাকে। 

কার্ডিওটক্সিন

কার্ডিওটক্সিন হচ্ছে এমন সব রাসায়নিক উপাদান (প্রোটিন) যা মানবদেহের হৃদপিণ্ডকে আক্রমণ করে।

আমাদের দেহ তিন ধরনের পেশি দিয়ে গঠিত - 

মসৃণ পেশি (Smooth Muscle) বা অনৈচ্ছিক পেশি : এই পেশিগুলোকে আমরা ইচ্ছাকৃতভাবে নাড়াতে পারিনা। মানবদেহের শ্বাসনালী, রক্ত সংবহনতন্ত্র, মূত্রনালী প্রভৃতি জায়গায় এই ধরনের পেশি দেখা যায়। 

অমসৃণ পেশি বা ঐচ্ছিক পেশি (Skeletal Muscle) : এই ধরনের পেশিকে আমরা ইচ্ছাকৃতভাবে নাড়াতে পারি। আমাদের দেহের হাত, পা, মুখ ইত্যাদিতে এই ধরনের পেশি দেখা যায়। 

হৃদপেশি (Cardiac Muscle): এই পেশিগুলোর গঠন ঐচ্ছিক পেশির মতো, কিন্তু কাজ অনৈচ্ছিক পেশির মতো। এগুলো শুধুমাত্র আমাদের হৃদপিণ্ডে অবস্থিত।


ছবি : মানবদেহের বিভিন্ন প্রকারের পেশি (PC : MedilinePlus)

কার্ডিওটক্সিন বিষ আমাদের দেহের হৃদযন্ত্রের হৃদপেশিকে আক্রমণ করে সেখানের কোষগুলোর মেমব্রেনকে ফাটিয়ে দিতে পারে, যার ফলে মানবদেহের হৃদযন্ত্রে অস্বাভাবিকতা কিংবা মৃত্যুও হতে পারে।

কার্ডিওটক্সিন বিষ মানবদেহের জন্য বেশ মারাত্মক একটা বিষ। এটির আক্রমণে নিম্নোক্ত সমস্যাগুলো হতে পারে।

কোষ বিদীর্ণ হওয়া : হৃদপিণ্ডের কোষগুলোকে ধ্বংস করে দিতে পারে (Cell lysis)

কার্ডিয়াক এরেস্ট (Cardiac Arrest) : হঠাৎ হার্ট বিট করা বন্ধ করে দিতে পারে

হার্ট অ্যাটাক (Myocardial Infarction) হতে পারে

আর্টারিওস্কেলেরোসিস (Arteriosclerosis) : চর্বি, কোলেস্টেরল প্রভৃতি উপাদান রক্তবাহিকায় জমা হয়ে রক্ত প্রবাহ বিঘ্ন হতে পারে কিংবা পুরো কার্ডিওভাস্কুলার সিস্টেমে গোলযোগ সৃষ্টি হয়ে পরিণতিটা মৃত্যু পর্যন্ত চলে যেতে পারে।

যেসব সাপ কার্ডিওটক্সিন ধারণ করে 

আফ্রিকার মোজাম্বিক স্পিটিং কোবরা (Naja mossambica), মধ্য এশিয়ার কাস্পিয়ান কোবরা (Naja oxiana) কিংবা অস্ট্রেলিয়ার তীব্র বিষধর Eastern Brown Snake (Pseudonaja textilis)। আমাদের দেশের পদ্ম গোখার ও খৈয়া গোখরার বিষেও অল্প পরিমানে কার্ডিওটক্সিনের মিশ্রন থাকে।

মায়োটক্সিন

মায়োটক্সিন হচ্ছে এক প্রকারের ক্ষুদ্র প্রোটিন বা পলিপেপটাইড যা প্রাণিদেহের মাংসপেশিতে আক্রমণ করে সেগুলোকে ধ্বংস করে দেয় (Myonecrosis)।

আমাদের দেহের তিন প্রকারের পেশির মধ্যে আমরা কেবল ঐচ্ছিক পেশি / কঙ্কাল পেশিকে (Skeletal Muscle) আমাদের ইচ্ছানুযায়ী নাড়াচাড়া করতে পারি। মায়োটক্সিন বিষ আমাদের এই কঙ্কাল পেশিকেই আক্রমণ করে পেশির কোষগুলোর কোষপর্দা ফাটিয়ে পেশিগুলোকে স্থায়ীভাবে ধ্বংস করে দেয়। 

মায়োটক্সিন বিষধর সাপের কামড়ের স্থানের পেশিগুলো আগে মারা যেতে পারে, তারপর অন্যান্য পেশিগুলো। বিষক্রিয়ার লক্ষণগুলোর মাঝে আছে -

কামড়ের স্থানে ব্যথা করা

মাংসপেশি ধ্বংস হওয়া / দূর্বল হয়ে যাওয়া বা পেশিতে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করা

মূত্রে রক্তের উপস্থিতি 

চূড়ান্ত পর্যায়ে কিডনি বিকল হয়ে যেতে পারে।

এলাপিডি পরিবারের সামুদ্রিক সাপগুলো নিউরোটক্সিনের পাশাপাশি শক্তিশালী মায়োটক্সিনও ধারণ করে। ভাইপারিডি পরিবারের Crotalus গণের ঝুমঝুমি সাপদের (Rattlesnakes) বিষেও মায়োটক্সিন বিষ পাওয়া যায়।

Post a Comment

0 Comments