Anguimorpha গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত ভ্যারানিডি গোত্রের সরীসৃপদেরকে আমরা Monitor Lizard (বাংলায় গুইসাপ) হিসেবে জানি। Varanidae গোত্রের সবগুলো প্রাণীই পৃথিবী থেকে ইতিমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে, শুধুমাত্র টিকে রয়েছে Varanus গণের কিছু গুইসাপ।
লম্বাটে গড়নের ঘাড় ও মাথা, বৃহদাকৃতির লেজ ও শক্তপোক্ত শরীর নিয়ে রীতিমতো দাপুটে স্বভাবের সরীসৃপ এরা। এদের জিহ্বা লম্বা ও সাপের মতো দু’ভাগে বিভক্ত (Forked & Snakelike)। বুদ্ধিমত্তার দিক দিয়েও এরা অন্যান্য সরীসৃপের তুলনায় যথেষ্ট বুদ্ধিমান।
পুরো পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত এদের মোট ৮০ টির মতো প্রজাতি শনাক্ত করা হয়েছে। প্রায় সবাই মাংশাসী (Carnivorous), কিন্তু ফিলিপাইনের বাসিন্দা বৃক্ষচারী তিনটি প্রজাতি আছে যেগুলো প্রধানত তৃণভোজী (Frugivorous, ফলমূল খায়)। আসলে সরীসৃপ শ্রেণীতে বেশিরভাগ সদস্যই মাংসাশী হয়ে থাকে, তবে এই তিনটি প্রজাতির (Varanus olivaceus, Varanus mabitang ও Varanus bitatawa) খাবারের বেশিরভাগ অংশেই থাকে ফলমূল যেগুলো মনিটর লিজার্ডদের মধ্যে অনন্য বৈশিষ্ট্য।
এশিয়া, আফ্রিকা ও ওশেনিয়া মহাদেশে গুইসাপদের বিস্তৃতি, তবে উত্তর আমেরিকার ফ্লোরিডা অঞ্চলে West African Nile monitor (Varanus niloticus stellatus) আগ্রাসী প্রজাতি (Invasive Specie) হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
এরা সবাই ডিম পাড়ার মাধ্যমে বংশবিস্তার করে, তবে অনেক প্রজাতি পার্থেনোজেনেসিসে সক্ষম।
এদের খাদ্য তালিকায় রয়েছে বিভিন্ন প্রকারের কীটপতঙ্গ, টিকটিকি - গিরগিটি, সাপ, পাখি ও ছোট ছোট স্তন্যপায়ী। এরা বিষধর, মাঝারি বিষ ধারণ করতে পারে, সাপের মতো এদেরও বিষগ্রন্থি আছে, তবে তা চোয়ালের নিচে থাকে। এদের মুখে বসবাসরত ব্যাকটেরিয়াগুলো মারা'ত্মক হতে পারে। তাই দূর্ভাগ্যবশত কামড় খেলে চিকিৎসা নিতে হয়, নয়তো কামড়ের স্থান পঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
এই গণের অন্তর্ভুক্ত ইন্দোনেশিয়ার কয়েকটি দ্বীপে বসবাসকারী কমোডো ড্রাগন (Komodo Dragon, Varanus komodoensis) হচ্ছে পৃথিবীতে স্থলে বসবাসকারী সবচেয়ে বড় সরীসৃপ, যেগুলো প্রায় ৩ মিটার লম্বা ও প্রায় ১০০ কেজি ওজনের হতে পারে। তবে জল ও স্থল মিলিয়ে সবচেয়ে বড় সরীসৃপ হচ্ছে লোনাপানির কুমির (Saltwater Crocodile, Crocodylus porosus)। এই কুমিরগুলো কমোডো ড্রাগনের চাইতে দ্বিগুন লম্বা (প্রায় ৬ মিটার) ও ওজনে প্রায় দশগুন বেশি (১০০০-১২০০ কেজি) হতে পারে।
![]() |
ছবি : কমোডো ড্রাগন ( From Prana by Atzaró) |
বাংলাদেশে এই গণের তিনটি গুইসাপ পাওয়া যায় (Varanus salvator, V. bengalensis এবং V. flavescens)।
রামগদি/ বড়গুই (Ring Monitor Lizard / Asian Water Monitor, Varanus salvator)
প্রধানত নিচু জমি, মিঠাপানি ও লোনাপানির জলাভূমি, উপকূলীয় বনাঞ্চল এবং কৃষিজমিতে বসবাস করে। অর্ধ-জলচর কিন্তু দক্ষ সাঁতারু। বাচ্চা অবস্থায় বৃক্ষচারী থাকে, বড় হয়ে স্থলচর হয়ে যায়। মাছ, ব্যাঙ, ইঁদুর জাতীয় প্রাণী, পাখি, কাঁকড়া, সাপ, কচ্ছপ- কাছিম প্রভৃতি খেয়ে বেঁচে থাকে।
![]() |
ছবি : রামগদি (From Thai National Parks) |
কৃষ্ণগোধিকা / বাংলাগুই (Bengal Monitor Lizard, Varanus bengalensis)
গাছপালার ঘন বন-জঙ্গলে বসবাস করতে পছন্দ করে, পাশাপাশি নিচুজমি, কৃষিজমি, আর্দ্র বন, পাথর ও বিল্ডিংয়ের ফাঁকফোকর প্রভৃতি জায়গায় থাকে। পুরোপুরিভাবে স্থলচর। শামুক, উইপোকা, চ্যালা (সেন্টিপেড), বৃশ্চিক, কাঁকড়া, মাছ, ব্যাঙ, সাপ, গিরগিটি, পাখি ও ছোট ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণিদেরকে খায়।
![]() |
ছবি : বাংলাগুই ( From The Reptile Database) |
স্বর্নগোধিকা / সোনাগুই (Golden Monitor Lizard / Golden Monitor, Varanus flavescens)
নদীতীরবর্তী অঞ্চল, খাল ও খাড়ি, কৃষিজমি, ঘাসবন, বনজঙ্গলের প্রান্ত ও নলখাগড়ার বনে থাকে। প্রধানত স্থলচর, তবে সুবিধাবাদী জলচর হতে পারে। ইঁদুর জাতীয় প্রাণী, সরীসৃপ, উভচর, কাঁকড়া, কীটপতঙ্গ, পাখির ডিম ইত্যাদি খেয়ে থাকে।
![]() |
ছবি : সোনাগুই (From India Biodiversity Portal) |
এইসব গুইসাপ আমাদের বাস্তুতন্ত্রের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি শিকারী প্রাণী। এরা কীটপতঙ্গ, ইঁদুর, সাপ প্রভৃতি খেয়ে আমাদের উপকার করে থাকে।
পুরো পৃথিবীব্যাপী গুইসাপদের সংখ্যা ক্রমেই কমছে, বিশেষকরে তাদেরকে পেট ট্রেড, ট্রাডিশনাল মেডিসিন, চামড়া শিল্প ও খাবারের জন্য ক্রমাগতই শিকার করা হচ্ছে। তাছাড়া অনেকে গুইসাপকে দেখলেই মে'রে ফেলেন, স্যান্ডা ভেবেও অনেকে উল্টাপাল্টা কাজ করেন। সুতরাং আমাদের সবাইকে গুইসাপ সংরক্ষণে এগিয়ে আসতে হবে এবং সমাজে গুইসাপ সচেতনা বৃদ্ধিতে তৎপর হতে হবে।




0 Comments