সাপ হচ্ছে কর্ডাটা পর্বের রেপটিলিয়া শ্রেণীর বুকে ভর দিয়ে চলা এবং শীতল রক্তবিশিষ্ট এক প্রকার প্রাণী। আমরা সাপকে তাদের বিষ এবং মানুষকে মারার কারনেই চিনে থাকি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীর অধিকাংশ সাপই নির্বিষ। বিষ সাপের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান যা দ্বারা তারা শিকার এবং নিজেদের আত্মরক্ষার কাজ করে থাকে। বিষকে সাপ তাদের খুবই দামী একটি জিনিস মনে করে।
এই আর্টিকেলটি সাপের বিষ সম্পর্কে মোটামুটিভাবে একটি ধারণা দিবে।
সাপের বিষ (Venom of Snake) হচ্ছে বিভিন্ন প্রকারের প্রোটিন এবং পলিস্যাকারাইডের সমন্বয়ে গঠিত একপ্রকার জটিল যৌগিক পদার্থ যা দ্বারা সাপ তার শিকারকে অবশ করা, হজম করা এবং নিজের আত্মরক্ষা করে থাকে। সাপের বিষ মূলত উচ্চতর বিষাক্ত লালা (Saliva) যা তাদের বিষগ্রন্থিতে (বিষগ্রন্থি মূলত মডিফাইড প্যারোটিড লালাগ্রন্থি) জমা থাকে।
সাপের বিষের বিষক্রিয়ার জন্য মূলত দায়ী বিভিন্ন প্রকারের প্রোটিন, এইসব প্রোটিন সাপের বিষের শুষ্ক ভরের প্রায় ৯০-৯৫% গঠন করে। এছাড়াও বিভিন্ন প্রকারের এনজাইম, পলিস্যাকারাইড ও প্রায় ২০ প্রকারের বিভিন্ন যৌগিক পদার্থের অস্তিত্ব সাপের বিষে পাওয়া গেছে। সাপের বিষে প্রাপ্ত কিছু এনজাইম হলো হাইড্রোলেজ, L-অ্যামিনো এসিড অক্সাইডেজ, কোলাজিনেজ, ইলাস্টেজ, নিউক্লিসাইডেজ, ফসফোডাইএস্টারেজ, ফসফোলাইপেজ, হায়ালিউরিনিডেজ, কোলিনেস্টারেজ, ডি-অক্সিরাইবোনিউক্লিয়েজ, হেপারিনেজ ইত্যাদি।
সাপের বিষ মূলত নিউরোটক্সিন (স্নায়তন্ত্রকে আক্রমণ করে), কার্ডিওটক্সিন (হৃদপিণ্ডকে আক্রমণ করে), মায়োটক্সিন (মাংসপেশিতে আক্রমণ করে), সাইটোটক্সিন (কোষে আক্রমণ করে), হেমোটক্সিন (লোহিত রক্ত কণিকাকে আক্রমণ করে), নেফ্রোটক্সিন (কিডনিকে আক্রমণ করে) ইত্যাদি।
![]() |
ছবি : নিউরোটক্সিন বিষধর ফিলিপাইন কোবরা (Source : Wikipedia) |
গোত্রভেদে সাপের বিষের বিভিন্নতা দেখা যায়। যেমন : এলাপিডি (কালাচ, খৈয়া গোখরা, পদ্ম গোখরা, শঙ্খিনী প্রভৃতি) পরিবারভূক্ত সাপেদের বিষ সাধারণত নিউরোটক্সিন আর ভাইপারিডি (চন্দ্রবোড়া, সবুজবোড়া প্রভৃতি) পরিবারভূক্ত সাপেদের বিষ সাধারণত হেমোটক্সিন।
সাপ তার বিষদাঁত দিয়ে শিকারের দেহে বিষ প্রবেশ করিয়ে থাকে, আবার অনেক প্রজাতির সাপ (যেমন : স্পিটিং কোবরা) ৬-৮ ফুট দূরে থেকেও বিষ ছুড়ে মারতে পারে।
সাপের বিষ ধরণ অনুযায়ী প্রাণিদেহের বিভিন্ন অঙ্গে আক্রমণ করে থাকে, অনেক প্রাণী সাপের বিষের বিরুদ্ধে নিজেদের দেহে এন্টি-ভেনম তৈরী করতে পারে (যেমন: ঘোড়া, বেজি, হানি বেজার ইত্যাদি)। তবে দুঃখের বিষয় হলো ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া ইত্যাদির বিরুদ্ধে আমাদের দেহে এন্টিবডি তৈরি হলেও সাপের বিষের বিরুদ্ধে কোনো এন্টি-ভেনম তৈরি হয়না। (তবে অনেকের দেহে ব্যক্তিগত ইমিউনিটি থাকে)।
সাপের বিষ যে শুধু ক্ষতিকর ব্যাপারটা কিন্তু সেরকম না, সাপের বিষের মধ্যে বিজ্ঞানীরা টিউমারবিরোধী (Antitumor), ক্যান্সারবিরোধী (Anticancer) বিভিন্ন উপাদান শনাক্ত করেছেন। প্রাণঘাতি ক্যান্সারের নিরাময় হয়তো সাপের বিষ থেকে পাওয়া যাবে!। তাছাড়াও সাপের বিষ পেইন কিলার হিসেবেও ব্যবহৃত হতে পারে।
সাপের বিষের ভয়াবহতা বুঝতে হলে বিষের তীব্রতা বুঝতে হবে। সাপের বিষের তীব্রতা বুঝাতে কয়েকটি টার্মেনোলজি সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। সাপের বিষের ক্ষেত্রে চার ধরনের তীব্রতার টেস্ট করা হয় -
1. Subcutaneous injection - চামড়ার নিচে
2. Intravenous injection - শিরায়
3. Intraperitoneal injection - দেহগহ্বরে
4. Intramascular injection - মাংসপেশিতে
এই পরীক্ষায় বিষ যদি চামড়ার নিচে চর্বির স্তরে প্রয়োগ করে পরীক্ষা করা হয়, তবে সেটাকে Subcutaneous Median Lethal Dose (SC LD50) বলে। আর বিষ যখন সরাসরি রক্তবাহিকায় (ভেইনে) প্রবেশ করে টেস্ট করা হয় তখন তাকে বলা হয় Intravenous Median Lethal Dose (IV LD50).
এগুলোর মধ্যে প্রথমটিকে অর্থাৎ Subcutaneous Median Lethal Dose (মারণ মাত্রা) বা SCLD50 এর মাত্রাকে মানুষের দেহে বিষক্রিয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে আদর্শ মান ধরা হয়।
পরীক্ষণীয় নমুনায় কোনো জীবগোষ্ঠীর অর্ধেক পপুলেশনকে (৫০%) মারতে ঐ সমস্ত নমুনায় মোট ভরের প্রতি কেজিতে একটি নির্দিষ্ট প্রাণীর যতটুকু বিষ প্রয়োজন হয় তার মানকে LD50 বলে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায় কোনো নমুনায় যদি ১০০টি ইঁদুর থাকে এবং প্রতিটির ভর যদি ৫০ গ্রাম করে হয়, তবে এই নমুনায় মোট ভর হবে ১০০×৫০ = ৫০০০ গ্রাম বা ৫ কেজি । এখন এই নমুনা ইঁদুরদের অর্ধেক পপুলেশনের ভর হলো ২.৫ কেজি। এই ২.৫ কেজি ভরের ইঁদুরদেরকে মারতে প্রতি কিলোগ্রাম ভরে যতটুকু বিষের প্রয়োজন হয় তার পরিমাণকে LD50 বলা হয়।

0 Comments